ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের ১৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী

ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের ১৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী

“ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারী ভুলব না” এই গানটি গেয়েই ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভাষা দিবসের প্রভাতফেরী করা হতো। এই গানটির রচয়িতা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ড, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গীতিকার আবু নছর মোহাম্মাদ গাজীউল হক, তিনি মুলত ভাষাসৈনিক গাজীউল হক নামেই সমধিক পরিচিত, ১৯২৯ সালের ১৩ ফ্রেব্রুায়ারী ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম মাওলানা সিরাজুল হক, যিনি ছিলেন ওলামা-এ  হিন্দ এর জেনারেল সেক্রেটারী এবং কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। মায়ের নাম মহিয়সী নূরজাহান বেগম। মাওলানা সিরাজুল হকের বাবা খাজা আব্দুল বারী ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা।

 

গাজীউল হক শিক্ষা জীবন শুরু করেন মক্তবে। পরবর্তীতে কাশিপুর স্কুলে ভর্তি হন এবং তখন শিক্ষক সুরেন বাবুর সান্নিধ্যে দেশপ্রেমে উদ্বদ্ধ হয়ে ছাগলনাইয়া থানার জ্যাগোব পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। পতাকা পোড়ানোর অভিযোগে তিনি চার ঘন্টা কারারুদ্ধ থাকেন। পরবর্তীতে সুরেন বাবু ছাড়িয়ে আনেন এবং তার বাবা মওলানা সিরাজুল হক কে বৃটিশ শাসকদের রোষানলে পড়তে পারে এই শঙ্কা থেকে তাকে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। ফেনী থেকে এসে ১৯৪১ সালে বগুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে আই.এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৬নং কক্ষে থাকতেন। ১৯৫১ সালে তিনি অনার্স ও ১৯৫২ সালে এম.এ পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ সালে এল.এল.বি ডিগ্রী লাভ করেন।

 

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক গাজীউল হকের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হলে, সরকারের চাপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এম.এ ডিগ্রি বাতিল করেন কিন্তু পরবর্তীতে ছাত্রনেতা ইশতিয়াক, মোহাম্মাদ সুলতান, জিল্লুর রহমান প্রমুখের আন্দোলনের মুখে আবার এম.এ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

 

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতে রাজপথে সবখানে। পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি কে তছনছ করে দেয়ার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি তে মিছিল, মিটিং, সমাবেশের উপর ১৪৪ ধারা জারি করলে জনাব আব্দুল হাসিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ১১-৪ ভোটে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেন যে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে না। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাত প্রায় বারোটার দিকে ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মাঝখানের পুকুরের পূর্ব ধারের সিঁড়িতে বিভিন্ন হলের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের নিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ও ২১ ফেব্রুয়ারীর কর্মসূচি ঠিক করার জন্য গাজীউল হক এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন জনাব হাবিবুর রহমান শেলী,  জনাব মোঃ সুলতান, জনাব জিল্লুর রহমান, জনাব আব্দুল মোমিন, জনাব এস এম বারী এটি, জনাব এম আর আখতার মুকুল, জনাব কামরুদ্দিন শহুদ, জনাব আনোয়ারুল হক খান, জনাব আনোয়ার হোসেন, মন্জুর  আহমেদ।এ বৈঠকেই স্থির হয়েছিল ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে এবং আমতলার সভায় গাজীউল হক সভাপতিত্ব করবে।

 

২১ ফেব্রুয়ারী বেলা ১১/১১.৩০ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভাঙার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সভা আরম্ভ হলে জনাব এম আর আখতার মুকুল,সভাপতি হিসাবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করেন এবং জনাব কামরুদ্দিন শহুদ প্রস্তাব সমর্থন করেন। সভাপতি হিসেবে গাজীউল হক প্রথম বক্তব্য প্রদান করার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে জনাব শামসুল হককে আহ্বান জানালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান করার কারণে উপস্থিত কিছু ছাত্র বক্তব্য প্রদানের বাধা দান করলেও তিনি বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে সভাপতি গাজীউল হক ৪৫ মিনিটের দীর্ঘ জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ১৪৪ ধারা ভাঙার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

 

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক হিসাবে ও পরে জাতীয় পর্যায়ের লেখক এবং সংগঠকের ভূমিকায় তাকে পাওয়া গেছে। তাকে পাওয়া গেছে ১৯৮০-র দশক জুড়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে।১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি অংশ নিয়ে বগুড়ার মুসলিম লীগকে শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করেন এবং কাগমারী সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে আওয়ামী লীগের সর্বাঙ্গীণ প্রতিকূলতা প্রতিরোধে মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহকমী হিসেবে কাজ করেন। ঐ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালন বন্ধের জন্য সরকার ধরপাকড় শুরু করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি গাজীউল হকসহ কয়েকজন নেতাকমীকে বগুড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। এবার প্রায় ২৯মাস কারাগারে তাকে থাকতে হয়। বগুড়ায় ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনের মূল চাবিকাঠি ছিল বিড়ি শ্রমিক ও মজদুরগণ। গাজীউল হকও ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই গাজীউল হক মাত্র ২৭জন যুবকসহ পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক গাজীউল হক, ডা. জাহিদুর রহমান অন্যান্য যুবকদের নিয়ে বগুড়া থানার আঙ্গিনায় জড়ো হন৷ থানার পুলিশ এবং ৩৯জন ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন৷ এসময় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ভাসানী ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দদের নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি হাই কমান্ড গঠন করা হয়। এই হাই কমান্ডের সদস্য ছিলেন গাজীউল হক। ২৭ মার্চ থেকে ১এপ্রিল ৬০ জন পুলিশের একটি দল পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ১ এপ্রিল গাজীউল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালিয়ে ৬৯ জন পাক সেনাকে বন্দি করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫৮ ট্রাক গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। ১৬ এপ্রিল গাজীউল হক অস্ত্র সংগ্রহ এবং অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভারত যান। হিলিতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে একটি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশবাণীস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন। 

 

প্রগতিশীল আন্দোলন ও অন্যান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তার মধ্যে পাবনা থিয়েটার পুরস্কার (১৯৭৭), রাষ্ট্রভাষা পদক (১৯৯৩), ভাষা সৈনিক পদক (১৯৯৭), সিপাপ জাতীয় স্বর্ণপদক (১৯৯৯), বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপ অর্জন (১৯৯৯), বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার (২০০০), একুশে পদক (২০০০), ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে জাহানারা ইমাম পদক (২০০১), বঙ্গবন্ধু পদক (২০০৩), শেরে-বাংলা জাতীয় পুরস্কার (২০০৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এ্যালামনাই এসোসিয়েশন-এর ৭ম পূণর্মিলনী (২০০৬)-তে তাঁকে ক্রেস্ট উপহার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তন (২০০৮)-এ তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দেওয়া হয়।

গাজীউল হক ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও। এছাড়া ও তিনি প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন । ২০০৯ সালের ১৭ জুন  ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান ভাষাসৈনিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

About BGIB

Bhashasoinik Gaziul Haque Institute of Bioscience(BGIB) is a Bioscience Based Higher Education and Research Institute which is Affiliated by University of Rajshahi.

Contact US

Bhashasoinik Gaziul Haque Institute of Bioscience(BGIB) Namajgar, Bogura

bgibbogura@gmail.com

01319972023

Social Link